বুধবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৫, ০৫:২২ পূর্বাহ্ন
সৈয়দ মেহেদী হাসান : সরকারি বরিশাল কলেজ টক অব দ্যা কান্ট্রি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সাহসী উদ্যোগের বিরোধীতা করতে গিয়ে দেশে চলমান কভিড-১৯ মহামারি, সাহেদ বা ডাঃ সাবরিনা ঝড় ছাপিয় আলোচনায় উঠে এসেছে, আসলে কি হওয়া উচিত? কলেজটির নামকরণ নিয়ে ইতিমধ্যে বরিশাল দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। মানবন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, স্মারকলিপি প্রদান ও মতবিনিময়-সব হয়েছে।
নেটিজেনদের আলোচনায় বিশেষ আলোকপাত হয়েছে দুইভাগে বিভক্তি। প্রথমত, হিন্দুদের নামে কলেজের নামকরণ করতে দেওয়া হবে না। দ্বিতীয়ত, কলেজ প্রতিষ্ঠায় সময়ের পরিক্রমায় বাকি যারা অবদান রেখেছেন তাদের কি প্রতিদান দেওয়া হবে? এর বাইরে কেউ কেউ রাজনৈতিক বিশ্লেষণও করছেন। তবে সেদিকে যেতে চাই না।
মূখ্য কথা হচ্ছে, ওই সম্পত্তির উপর দক্ষিণবঙ্গে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আধুনিকায়নে যার অবদান অগ্রগন্য তার থাকার ঘর ছিল। এই তথ্য মোদ্দা কথায় কেউ অস্বীকার করেন না।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, নাম পরিবর্তনের দরকার কি? মহাত্মা অশ্বিনীতো আমাদের হৃদয়ে আছেন। যারা এমন কথা বলছেন, আমি মনে করি তাদের হৃদয় নেই। কারন, যদি বরিশালবাসীর হৃদয়ে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত ভাস্বর হয়ে থাকতেন তাহলে তার বসতঘরটি মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত জাদুঘর হত। সেটি ভেঙ্গে ফেলা হতো না।
বাঙালী জাতি প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ত্যাগ করেছেন তা হয়তো অতীত ইতিহাসে কেউ করেননি।করবেনও না। সেই মানুষটিকে কিন্তু নির্মমভাবে খুন করেছিল এই বাঙালীরা। কোন পাকিস্তানি বা ব্রিটিশরা নয়। জাতি প্রতিষ্ঠাতার যদি এমন প্রস্থান হয়, তাহলে শিক্ষা প্রসারে অবদান রাখা মহাত্মা অশ্বিনীকে যে তারচেয়ে আগেই মুছে ফেলা হবে হৃদয় থেকে; তা আর বলতে বেগ পেতে হয় না।
ফলত, সময়ের দাবী বরিশাল কলেজকে অশ্বিনী কুমার দত্তের নামে নামকরণ করে তার প্রতি বরিশালবাসীর ঋণ অন্তত একটু হলেও শোধ করার। একটুকু হলেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার।
কলেজের নামকরণ নিয়ে এর আগে গুঞ্জন হলেও একটি মানবন্ধন যথারীতি স্ফুরণ ঘটিয়েছে। বিস্ময় বাড়িয়েছে আমাদের। মানববন্ধনে ক্ষমতাশীন ও ক্ষমতাহীনরা ঐক্যজোট হয়ে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার নামকরণ প্রত্যাখান করেছেন। পাশাপাশি দাবী তোলা হয়েছে, কয়েকজন বিশিষ্টজনের অবদানের স্বীকৃতী স্বরূপ তাদের নাম ব্যবহারের।
তাতেও অসুবিধা নেই। কিন্তু সেখানে রাজাকার আবদুর রহমান বিশ্বাস ও বরিশাল জেলা পিস কমিটির ট্রেজারার গোলাম মাওলার নাম উত্থাপন করে যুবদল নেতা যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতেই স্পষ্ট তাদের দূরভিসন্ধি। হ্যাঁ, একটি কলেজের নামকরণ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে কথা-তর্ক হতেই পারে। কিন্তু প্রকাশ্যে মানববন্ধনে রাজাকার আবদুর রহমান বিশ্বাস ও বরিশাল জেলা পিস কমিটির ট্রেজারার গোলাম মাওলার সাফাই গীত উত্থাপন আমি মনে করি অপরাধ। ওই বক্তা হয়তো আরেকটু সুযোগ পেলে দেলোয়ার হােসেন সাঈদীর নামও বলতেন। কারন, তার বক্তব্য বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তনে সরকারি প্রস্তাবের বিপরীতে উলম্ফন।
রাজাকারের নাম এত দ্বার্থহীনভাবে বরিশালে কেউ বলে পার পেতে পারেনি। কিন্তু সেটাই করা হলো, তাও পাশে ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষশক্তি আ.লীগের মহানগর কমিটির সভাপতি। যখন মহাত্মা অশ্বিনী কুমারকে বিষোদগার করে এবং রাজাকারকে বড় করে কথা বলা হচ্ছিল তখন কি মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির বিবেকে একটুকুও নাড়া দেয়নি?
মনে রাখতে হবে, মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত ব্রিটিশবিরোদী আন্দোলনের নেতা। শিক্ষা প্রসারের মহানায়ক। তিনি মানুষের হাতে শিক্ষার মশাল তুলে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে বিএনপি কিন্তু রাজাকারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন জাতীয় পতাকা। সেই মানুষদের সাথে ঐক্যমত হলেন কিভাবে? আপনাদের কণ্ঠ এই এক জায়গায় ঐক্যজোট হলো কোন পদ্ধতিতে? জাতীয় সংকটেওতো আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এক টেবিলে বসতে দেখিনি। ব্যাপারটি স্পষ্ট নয়। তাহলে কি বরিশালে ক্ষেত্র বিশেষে রাজনীতি শিথিল হয়?
যা হােক, সরকার যে নামটি যথাযোগ্য মনে করবেন সেটি রাখবেন। তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। এখানে হয়তো পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু ‘বরিশাল কলেজে অশ্বিনী বাবুর কোন অবদান নেই’ এমন বাক্য প্রচার করাটা্ও কি অন্যায় নয়?
এটি মানতে হবে এবং মেনে নিয়েছেন, বরিশাল কলেজ যে সম্পত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত তা মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তর সম্পত্তি ছিল। তিনি কারও কাছে বিক্রি করে যাননি। সুতরাং মহান এই মানুষটির সম্পদ তার নাম থেকে আলাদা করাটাও ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি অন্যায়। যদি ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে যান তাহলে আরও স্পষ্টভাবে ব্যাখা করা যাবে।
জমি কিংবা বসত ভিটার সীমানা সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে বিরোধ, দুর্বল, এতিম, সংখ্যালঘু ও বিধবার সম্পত্তি থেকে নাম সরিয়ে ফেলা/জবর-দখল, সরকারী খাস জমি, পুকুর, খাল, নদ-নদী ও জলাশয় দখল করে দোকানপাট ও মার্কেট নির্মাণ, জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা, অন্যের সীমানার ওপর বাড়ি ঘর নির্মান করা ইসলামিক পরিভাষায় জুলুম বলে সংজ্ঞায়িত হয়।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে-রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন ‘জুলুম’ কিয়ামতের দিন অনেকে অন্ধকার রূপ ধারণ করবে। ( বোখারি শরীফ:২২৮৫)।
হযরত সাঈদ বিন জায়েদ (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে-রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কারো এক বিঘত জমিন (সম্পত্তি) জোর পূর্বক অন্যায় ভাবে দখল করবে; কিয়ামতের দিন সাত স্তবক (সাত স্তর বিশিষ্ট) জমি হতে ঐ জমিটুকু তার গলায় বেড়ি রূপে পড়িয়ে দেয়া হবে। (বোখারী ও মুসলিম:২২৯১)।
হযরত সালিম তার পিতা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি অন্যায় ভাবে কারো কিছু নিবে, কিয়ামতের দিন তাকে সাত স্তবক জমিন পর্যন্ত মাটির নিচে ধ্বসিয়ে দেয়া হবে। (মিশকাত:২৮২৩)।
হযরত ইয়ালা বিন মুররা (রা) হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি অন্যায় ভাবে কারো জমিন দখল করে, তাকে আল্লাহ পাক তা সপ্ত স্তর পর্যন্ত খনন করতে বাধ্য করবেন, তারপর তার গলায় তা বেড়ি রূপে পড়িয়ে রাখা হবে-সকল মানুষের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত। (মিশকাত:২৮৩১)।
জোর পূর্বক কারও সম্পত্তি দখল করার মতো গোনাহের কাজ। তাছাড়া জোর পূর্বক অন্যের সম্পত্তি দখলকারীকে সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকতে ইসলামে সরাসরি নির্দেশ রয়েছে। ইসলামে কোথাও উল্লেখ নেই, অন্যের জমি থেকে তার অধিকার বা স্বত্ব বা তার নাম মুছে ফেলা যাবে। বরংছ এমন কেউ করলে তা জুলুম।
সেমতে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের অবিক্রিত জমি তার সম্পত্তি। তার অবর্তমানে তার ওয়ারিশদের। আর যদি ওয়ারিশ না থাকে তাহলে সেই সম্পত্তির মালিক রাষ্ট্র। স্থানীয় কোন প্রতিবেশী হতে পারেন না। রাষ্ট্র মনে করছেন, কলেজের নামটি মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের নামে প্রতিষ্ঠা পাবে। সে অনুসারে সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু অনেকে এসে বলেছেন, মহাত্মা অশ্বিনী কুমারের নাম ব্যবহার করা চলবে না। আপনাদের এই প্রস্তাব কি জুলুম নয়?
তাই বলি ভাই, যারা মনের অন্দরে এখনো ধারণ করছেন যে হিন্দুদের নামে কলেজ হতে দেব না; তাদের প্রতি অনুরোধ ওইভাবে বিবেচনা করবেন না। ইসলাম কিন্তু অন্যের সুনাম ক্ষুন্ন করা, অস্বীকার করা বা উপকারকারীর প্রতি অকৃতজ্ঞ হতে বলেনি। বরংছ সূরা আলে ইমরানের ১৪৪ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করেছেন, আল্লাহ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনকারীদের অচিরেই প্রতিদান দেবেন।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক; মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের বিরোধীতা করার নেপথ্য কি তিনি হিন্দু ধর্মের ছিলেন সে কারনে? নাকি আর কোন কারন আছে? কতিপয় লোক মুখে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করছেন, বরিশাল কলেজের নাম হিন্দু ধর্মের অনুসারী মহাত্মা অশ্বিনী কুমারের নামে হলে হিন্দুত্ববাদকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এবং এভাবে পর্যায়ক্রমে হিন্দুদের আওতায় চলে যাবে বরিশাল। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এমন কূপমন্ডুকের মতন বিশ্লেষণের মুখোমুখি হবো, ভাবা যায়? তার মানে কি, হিন্দু হওয়াটা তার অন্যায় হয়েছে? এতকিছু দান করার পরও ধর্মীয় বিভেদ, গোত্রের হিংসা আমাদের শিক্ষিত করতে পারেনি? এটা কি ধর্মীয় অনুভূতিতে বা ধর্মে আঘাত নয়? হিন্দু ধর্মের মানুষের নামে কলেজ হতে পারবে না; এমন কােন নির্দেশনা বা সাংবিধানিত ব্যাখ্যা নেইতো। বাংলাদেশ তো সেই দর্শন বিশ্বাস করে না। তাহলে ওরা কারা? যারা এখনো ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে মূল্যায়ন করছে? এটি ধর্মীয় অবমূল্যায়ন বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের সামিল। যা সাংবিধানিকভাবেই অপরাধ। বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারার আইনে কারও ধর্মকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা অপরাধ এবং শাস্তির বিধান আছে৷ মোটা দাগে এই অপরাধগুলো হলো: ২৯৫ (ক) – কোনো বা যে কোনো বিশেষ ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা করে উক্ত যে কোনো ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর আঘাত হানার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত বিদ্বেষাত্মক কাজ৷ ২৯৮ – ধর্মীয় অনুভূতি আঘাত করার উদ্দেশে শব্দ উচ্চারণ বা অঙ্গভঙ্গি৷এই আইনে অপরাধ প্রমাণ হলে ১০ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এককোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান আছে৷
সুতরাং আমি মনে করি, সরকারের সিদ্ধান্তে আপনার পছন্দ না হলে দ্বিমত করতে পারেন। কিন্তু হিন্দু বলে কলেজের নাম তার নামে হতে পারে না, সেই চিন্তা/প্রচারণা থেকে বিরত থাকুন। মানসিকতাকে উন্নত করুন। ধর্ম নয়, মানুষকে তার অবদান, কর্মের গুনে বিচার করুন।
লেখক: সাংবাদিক ও কবি